গর্ভফুল আটক হওয়া

পর্ব-৩৩

             গর্ভফুল আটক হওয়া
             Retained Placenta

এনডোমেট্রিয়াম ও করিয়ন এর সংযোগকারী অঙ্গের নাম গর্ভফুল। সাধারনত গাভীর গর্ভধারনের ৩২ দিন পর থেকেই গর্ভফুলের কার্যক্রম শুরু হয়। এই গর্ভফুলের মাধ্যমে গর্ভস্থ বাচ্চা মায়ের কাছ থেকে অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড ও পুষ্টি গ্রহন করে থাকে এবং গাভী বাচ্চা প্রসবের ৪ থেকে ১২ ঘন্টার মধ্যেই এই গর্ভফুল পড়ে যায়। তবে গর্ভফুল পরে যাওয়ার স্বাভাবিক সময় হিসাবে বিবেচনা করা হয় ১২-২৪ ঘন্টা। বাচ্চা প্রসবের ২৪ ঘন্টার মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে গর্ভফুল না পড়লে তাকে গর্ভফুল  আটকে যাওয়া (Retained Placenta) বলে। দুর্বল ও উন্নত জাতের গাভীতে এ রোগ বেশি হয়ে থাকে।

গাভীর গর্ভফুল পরা একটি জটিল শারীরিক, যান্ত্রিক ও হরমোন ঘটিত প্রক্রিয়া। কিছু গাভীতে বাচ্চা প্রসবের পর গর্ভফুল স্বাভাবিক নিয়মে পরলেও অনেক গাভীতে তা আটকে যায়। গর্ভফুল বেশি দিন আটকে থাকলে জরায়ু প্রদাহ ও সেপ্টিসেমিয়ার কারনে পশু মারা যেতে পারে। তবে কেন আটকে যায়, এর কারন, লক্ষন, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে ধারনা থাকলে এ সমস্যা বহুলাংশে এড়ানো সম্ভব।

                               কারন

> গর্ভাবস্থায় গাভীর শরীরে ক্যালসিয়াম, আয়রন, এডি৩ই ও মিনারেলের অভাব হলে।
> গর্ভকালিন সময় কাচা ঘাস ও সুষম খাদ্য না খাওয়ালে।
> নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে বাচ্চা প্রসব করলে।
> গর্ভপাত, অপরিনত, মৃত, বিকলাঙ্গ বাচ্চা, যমজ বাচ্চা প্রসব করলে গর্ভফুল আটকে যাওয়ার হার ৪৬%।
> জোরপুর্বক বাচ্চা টেনে হিচরে বের করলে অর্থাৎ কষ্ট প্রসব বা প্রসব বিঘ্নতা ঘটলে।
> রক্তে ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাব ও অপুষ্টি হলে।
> গর্ভবতী গাভীতে ছত্রাক জাতীয় সংক্রমক রোগ ব্রুসেলোসিস, ভিব্রিওসিস, যক্ষ্মা হলে।
> জরায়ুর মাংশপেশীর সঙ্কোচন হীনতা।
> প্রসবের পর বাচ্চাকে সরাসরি ওলান থেকে শাল দুধ চুষে না খাওয়ালে।

                                 লক্ষন

> গাভী বাচ্চা প্রসবের ২৪ ঘন্টা অতিবাহিত হওয়া সত্বেও গর্ভফুল না পরাই হলো অন্যতম প্রধান লক্ষন।
> বাচ্চা প্রসবের পর গর্ভফুলের অর্ধেকটা বের হয়ে নিচের দিকে ঝুলে থাকে।
> গাভীর অল্প জ্বর, অস্বস্তি বোধ ও খাওয়ার অরুচি দেখা যাবে।
> গর্ভফুল বের করার জন্য বার বার কোঁথ দিবে ফলে জরায়ু বের হয়ে আসতে পারে।
> ভাজাইনাল ও জরায়ুর প্রোলাপস হতে দেখা যায়।
> প্রসাব করার সময় দুর্গন্ধ হবে ও দুধ কমে যাবে।

                               প্রতিরোধ

© গর্ভাবস্থায় গাভীকে দৈনিক ১০-২০ কেজি কাচা ঘাস ও প্রয়োজনীয় মাত্রায় সুষম দানাদার খাবার এবং দৈনিক ০.১ পিপিএম সেলিনিয়াম+ ভিটামিন এডি৩ই খাওয়াতে হবে। পাশাপাশি দৈনিক কমপক্ষে ১ ঘন্টা ব্যায়াম (হাটা চলা) ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিয়মানুযায়ী কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়াতে হবে।

© প্রসবের পর বাচ্চাকে সরাসরি বাট থেকে শাল দুধ চুষে খাওয়াতে হবে। তাহলে গাভীর রক্তে অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসরণ বেড়ে যায় এবং গর্ভফুল পড়তে সহজ হয়।

© বাচ্চা প্রসবের আধা ঘন্টার মধ্যে ১০-১৫ লিঃ কুসুম কুসুম গরম পানির সাথে আধা কেজি পুরাতন আখের গুড় মিশিয়ে খাওয়াতে হবে এবং অক্সিটোসিন জাতীয় ঔষধ যেমন inj: Oxcin 5ml. মাংশে দিলে দ্রুত গর্ভফুল পরে যায়।

© এছাড়াও পাশাপাশি গর্ভফুলের বাহিরের ঝুলন্ত অংশের সাথে আধা কেজি ওজনের ইট বা কাঠের টুকরা বেধে দিলে গর্ভফুল পরতে সহজ হয় এবং প্রসবের ৪ ঘন্টা পর Syr: Utrocare or Utroclean 500ml. খাওয়ালে ভাল ফল পাওয়া যাবে।

                                চিকিৎসা

® যেহেতু গর্ভফুল পড়ার স্বাভাবিক সময় ২৪ ঘন্টা, অতএব ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর চিকিৎসা শুরু করা যেতে পারে। যদি ২৪ ঘন্টার মধ্যে গর্ভফুল না পরে তাহলে বাহিরের ঝুলন্ত অংশ যতদুর সম্ভব টেনে ধরে কেটে দিতে হবে এবং অক্সিটেট্টাসাইক্লিন টাবঃ + মেট্রোনিডাজল টাবঃ দুটি করে একত্রে গুড়া করে Uto-pessury হিসাবে জরায়ুতে প্রয়োগ করতে হবে পরপর ২-৩ দিন। যোনীদ্বারে যাতে মাছির উপদ্রপ কম হয় সেজন্য ভাজাইনার চারিদিকে তারপিন তৈল লাগিয়ে রাখতে হবে। কয়েক দিনের মধ্যেই গর্ভফুল আপনা আপনি পঁচে পঁচে বের হয়ে যাবে জরায়ুর কোনরুপ ক্ষতি ছাড়াই। তবে এক্ষেত্রে ইউট্রোকেয়ার সিরাপ খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়।

                   হাত দিয়ে বের করা প্রসঙ্গে

গর্ভফুল হাত দিয়ে টেনে বের করা যাবে না। এতে গর্ভফুলের ১০০% বের করা সম্ভব হয় না বরং হাত দিয়ে বের করলে জরায়ুতে ক্ষতের সৃষ্টি সহ সেপ্টিক ম্যাট্রাইটিস, পায়োমেট্রা, রক্তক্ষরন, স্থায়ীভাবে গর্ভধারন করতে না পারা এমনকি জরায়ু প্রদাহে আক্রান্ত হয়ে গাভীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। যদি হাত দিয়েই গর্ভফুল বের করার একান্ত প্রয়োজন হয় তাহলে অবশ্যই বাচ্চা প্রসবের কমপক্ষে তিন দিন পর অভিজ্ঞ ভেটেরিনারি ডাক্তার দ্বারা বের করা উচিত। প্রসবের তিন দিন পর গর্ভফুল খুব সহজে বের করা যায়। কারন জরায়ুর মাংশপেশীর সঙ্কোচন হতেই সময় লাগে ৪৮ ঘন্টা। গর্ভফুল বের করার পর Oxytetracyclin অথবা Penicillin গ্রুপের ঔষধ এ.আই টিউবের মাধ্যমে জরায়ুতে প্রয়োগ করতে হবে ৩-৫ দিন। দশ-পনেরো দিন পর পুনরায় ডাক্তার দ্বারা জরায়ু পরীক্ষা করতে হবে জরায়ু প্রদাহ হয়েছে কিনা! আর যদি গর্ভফুল আটকে যাওয়ার পরেও গাভীর খাওয়া দাওয়া, চলাফেরা, তাপমাত্রা সব কিছুই স্বাভাবিক থাকে তাহলে হাত দিয়ে বের করার দরকার নেই।

বিঃ দ্রঃ এই গর্ভফুল পরার সঠিক পদ্ধতি/প্রক্রিয়া এখনোও সম্পুর্ন ভাবে জানা যায়নি।

তথ্য ও সহযোগীতায়   
ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার
DVM; MSc (obstetrics)
উপজেলা প্রাণীসম্পদ অফিসার, কাউনিয়া, রংপুর।

No comments

Powered by Blogger.