হাঁস-মুরগি পালন করে জামাল আজ কোটপতি

সংসারে অভাব-অনটনের কারণে জামাল হোসেন ভোলা তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। কষ্টে কেটেছে তার শৈশব ও কৈশোর। বিয়ের পরও তিনি সংসার চালাতেন শ্রমবিক্রি করে। নিজ গ্রামের পাশপাশি অন্য জেলায় গিয়েও শ্রমবিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতেন জামাল। কিন্তু অভাবের রাহুগ্রাস থেকে কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছিলেন না ।
অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সংসারের অভাব আর বেকারত্ব ঘোচাতে উদ্যোগ নেন হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তোলার। কিন্তু হাতে পুঁজি না থাকায় সে ইচ্ছাও নিভু নিভু করছিল। পরে বেশ কষ্টে ধারদেনা করে প্রথমে ৪০টি হাঁস কিনে একটি মিনি খামার তৈরি করেন জামাল হোসেন (৪৮)।
এরপর জামাল হোসেনের সফলতার গল্প। অল্প সময়ে ইচ্ছাশক্তি আর কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে সফলতা দেখিয়ে এলাকার লোকজনকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে নিজ বাড়ির পাশেই ল্যাংগা খাল ও রাজবাড়ীর খাস পুকুরে গড়ে তুলেছেন ‘লিটন হাঁস-মুরগির খামার ও হ্যাচারি।’ তার খামার ও হ্যাচারিতে এখন নারীসহ ৯ জন শ্রমিক কাজ করছেন।
জামালের বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সর্বানন্দ ইউনিয়নের রামভদ্র-রাজবাড়ী গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের ভূমিহীন প্রান্তিক কৃষক জবেদ আলীর ছেলে। জামাল হোসেন ভোলা এ বিষয়ে বললেন, ‘বেকারত্ব ঘোচাতে ১৯৯০ সালের শুরুতে ৪০টি হাঁস কিনে মিনি খামার প্রতিষ্ঠা করি। বাড়ি সংলগ্ন ল্যাংগা খাল ও রাজবাড়ীর খাস পুকুরে হাঁসগুলো লালন-পালন করতে থাকি। এরপর এগুলো ডিম দিতে শুরু করে। ডিম বিক্রির টাকা হাতে আসার পর থেকে আমাকে আর পিছনের দিকে তাকাতে হয়নি।’
তিনি আরও বললেন, ‘এরপর ১৯৯০ সালের শেষের দিকে আরও ১৫০টি হাঁস ক্রয় করি। হাঁসের ডিম বিক্রির আয় থেকে দুই বছরের মধ্যে তুষ পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা ফোঁটানো শুরু করি। পরের বছর বাড়ির পাশে ল্যাংগার বাজারে “লিটন ট্রেডার্স” নামে হাঁসের খাদ্যের জন্য একটি দোকান প্রতিষ্ঠা করি। দোকান ও হাঁসের খামারের আয় দিয়ে ১৯৯৪ সালে ৫০০ লেয়ার মুরগি দিয়ে একটি খামার প্রতিষ্ঠা করি। আস্তে আস্তে মুরগি বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৩ হাজার লেয়ার মুরগি আছে খামারে। এ ছাড়া এখন খামারে প্রায় পাঁচ শ’ হাঁস রয়েছে। এর পরের বছরই প্রতিষ্ঠা করি লেয়ার মুরগির খাদ্যের জন্য একটি দোকান।’
জামাল হোসেন বললেন, ‘১৯৯৮ সালে যুব উন্নয়ন অধিদফতর ও আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্প কর্তৃক পরিচালিত ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এ ছাড়া ২০০২ সালে পোল্ট্রি সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প কর্তৃক আয়োজিত বাণিজ্যিক মুরগি উৎপাদন ব্যবস্থাপনার উপর ৭ দিনের প্রশিক্ষণও নিয়েছি।’
এ সফল খামারী আরও বললেন, ‘প্রতিদিন লেয়ার মুরগির খামার থেকে ২৭০০ থেকে ২৯০০ ডিম পাওয়া যায়। প্রতিমাসে কমপক্ষে ৮০ হাজারের অধিক মুরগির ডিম ও ২৫ থেকে ৩০ হাজার হাঁসের বাচ্চা বিক্রি করি। বাচ্চা ফোঁটাতে তার নিজের খামার ছাড়াও অন্যান্য খামার থেকে ডিম সংগ্রহ করি। সব মিলে হাঁস, মুরগি, হ্যাচারি ও দোকানে দুইজন নারীসহ মোট ৯ জন কর্মচারী রয়েছেন।’ জামাল জানালেন, ৩ ছেলে ২ মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। তিনি ছেলে-মেয়েদের গড়ে তুলতে তাদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। তার বড় ছেলে রাশিদুল ইসলাম চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্সি পড়ে, মেঝ ছেলে রাশেদ রংপুর কালেক্টরেট স্কুল এ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ও ছোট ছেলে রিপন নজরুল প্রি-ক্যাডেট স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। জামাল হোসেনের বড় মেয়ে লাভলী আক্তার কাটগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণী ও ছোট মেয়ে লাবণী আক্তার বামনডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে। তিনি আরও জানালেন, হাঁস-মুরগির খামার ও হ্যাচারি থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে সব ব্যয় মেটানোর পর একটু একটু করে কিছু আবাদি জমিও কিনতে পেরেছেন। এবং তার এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এলাকার দেড় শতাধিক বেকার যুবক হাঁস-মুরগির খামার প্রতিষ্ঠা করেছেন। কেবল তা-ই নয়, তিনি তাদের খামার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা করে আসছেন। জামাল হোসেনের বড় ছেলে রাশিদুল ইসলাম লিটন বললেন, ‘বাবা হাঁস, মুরগি ও দোকানের পাশাপাশি সম্প্রতি ইনকিউবিউটর মেশিনের দ্বারা হাঁস-মুরগির বাচ্চা ফোঁটানো শুরু করেছেন। এক সময় আমরা খড়ের ঘরে থাকতাম। এখন খামার ও হ্যাচারির আয়ে আমাদের পাকা ঘর হয়েছে। আমাদের সচ্ছলতা ফিরেছে।’ সুন্দরগঞ্জের শিক্ষক ও সমাজকর্মী জাহিদুল ইসলাম জাহিদ জামাল হোসেন সম্পর্কে বললেন, ‘এক সময় জামালের সংসার চলত না। আর এখন সেই জামাল সফলতার মুখ দেখেছেন, ঘুচিয়েছেন বেকারত্ব। তাকে দেখে অনেকেই আজ সফল ও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠ

No comments

Powered by Blogger.